ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক এ দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মুখী সমস্যা হলেও মানুষ প্রায়ই সমস্যা দুটিকে গুলিয়ে ফেলে। ব্রেইনের সমস্যা হলে হূদরোগের হাসপাতালে যায়। এতে সময় নষ্ট হয়, রোগীর সমস্যা বেশি হয়, স্ট্রোক থেকে আরোগ্য লাভে দেরি হয়, এমনকী রোগীর মৃতু্য পর্যন্ত হতে পারে। মস্তিষ্কের কাজের ব্যাঘাত ঘটা, যেমন শরীরের একপাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া, অজ্ঞান হওয়া বা খিঁচুনী শুরু হয়ে যাওয়া, কথা অস্পষ্ট থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া, চোখে দেখতে অসুবিধা হওয়া অথবা খাদ্য বা পানি গিলতে অসুবিধা হওয়া, এসবের যে কোন একটা বা এক সাথে একাধিক উপসর্গ হলেই স্ট্রোক হয়েছে ধরে নিতে হবে।
অপরদিকে হার্ট অ্যাটাক হলে বুকে ব্যথা, বুকে চাপ ভাব হবে, শ্বাস কষ্ট হতে পারে, রোগী অস্বাভাবিক ঘামতে পারে বা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। রোগীর নাড়িরচাপ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে পারে বা রক্তচাপ কমে যেতে পারে বা রক্ত চাপ একদম শুন্যের কোঠায় পেঁৗছাতে পারে। এ থেকেই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না, রোগীর ব্রেইনে নয়, হার্টে সমস্যা হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক বিরল রোগের সাথে স্ট্রোকের সম্পর্ক আছে যা জনসাধারণের জন্য দুর্বোধ্য হতে পারে বিধায় উলেস্নখ করা হলো না। আমরা এখানে আমাদের আলোচনা মস্তিষ্কের স্ট্রোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব।
যারা ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ রোগে ভোগেন, যারা ধূমপায়ী, যাদের রক্তে চর্বি বেশি থাকে এবং যারা শরীরের ওজনের আধিক্যে ভোগেন, তাদের শরীরের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের রক্তনালীগুলি সরু, শক্ত ও শুকিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতায় ভোগে। এর মধ্যে মস্তিষ্ক ও হূদযন্ত্রের রক্তনালীগুলিই প্রধান। এছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির ব্যবহার, হূদযন্ত্রের কিছু রোগ, কিছু রক্ত রোগ, বয়স, পূর্বের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এবং রক্তনালীর চড়ার বিচু্যতির সাথেও স্ট্রোকের সম্পর্ক আছে।
স্ট্রোককে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
০০ মস্তিষ্কে সাময়িক রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত হয়ে স্ট্রোক: যা ২৪ ঘন্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যায়
০০ সাময়িক পক্ষাঘাত: এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো প্রকার দুর্বলতা না রেখেই ঠিক হয়ে যায়
০০ ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি লাভ করা স্ট্রোক: ২৪ ঘন্টার মধ্যে ক্রমান্নয়ে বাড়তে থাকে
০০ পরিনত স্ট্রোক: যা ক্রমান্নয়ে বাড়তে বাড়তে ২৪ ঘন্টার মধ্যে পূর্ণতা লাভ করে
০০ পূর্ণ স্ট্রোক: ২৪ ঘন্টার মধ্যে পূর্ণতা লাভ করে এবং স্থায়ী পক্ষাঘাত করে ফেলে
বিভিন্ন ধরণের স্ট্রোকের ফলে যা হতে পারে:
০০ রক্তনালী ক্রমান্নয়ে সরু হয়ে বা চড়া পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া অথবা হার্ট বা রক্তনালী থেকে চড়ার বিচু্যতি হয়ে মস্তিষ্কের রক্তনালীর প্রবাহ বন্ধ হওয়া-এ ধরনের সমস্যাই সব চেয়ে বেশি, প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ
০০ মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়া-যাকে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বলা হয়, তা প্রায় ১০ ভাগ
০০ মস্তিষ্কের বাইরে কিন্তু মস্তিষ্কের আবরনীর ভেতরে রক্তক্ষরণ, যা প্রায় ৫ ভাগ
এছাড়াও মস্তিষ্কের রক্তনালীর বহিরাবরনী দ্বিক্ষন্ডিত হয়ে মস্তিষ্কের ব্যবহূত রক্তনালী গুলি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং মস্তিষ্ক আবরনীগুলির মধ্যে বা বাইরে রক্তপাত হলেও স্ট্রোকের মত উপসর্গ হবে। উলেস্নখিত বর্ণনায় স্ট্রোক সম্বন্ধে আপনাদের একটি প্রাথমিক ধারনা নিশ্চয়ই হয়েছে। একটি বিষয় পরিষ্কার থাকা উচিৎ যে, একজন স্ট্রোকের রোগী প্রায় স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে একজন চিকিৎসকের কাছে এসে বলতে পারেন যে- আমি আমার মাথায় অসুবিধা অনুভব করছি। আবার কারো ক্ষেত্রে নিম্নলিক্ষিত উপসর্গগুলিও হতে পারে। যেমন:
০০ হাঁটতে বা দাঁড়াতে অসুবিধা
০০ হঠাৎ করে অস্বাভাবিক আচরণ বা অস্বাভাবিক কথা বলা
০০ কথা বা কাজ কর্মে ভুল করা
০০ মাথা ব্যথা হওয়া
০০ শরীরের একপাশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়া
০০ কথা জড়িয়ে যাওয়া
০০ কথা বলতে না পারা বা খাদ্য গিলতে অসুবিধা হওয়া ইত্যাদি। অবস্থা আরো গুরুতর হলে, চেতনা লোপ থেকে রোগী গভীরভাবে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
স্ট্রোক সম্বন্ধে এই বর্ণনা জনসাধারণের উপলব্ধির জন্য। এর পরের করনীয় অবশ্যই একজন চিকিৎসকের। অতএব রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে নিতে হবে, বিশেষ করে একজন স্নায়ুরোগ বা স্ট্রোক বিশেষজ্ঞের কাছে। ভুল করে বা অজ্ঞতাবশত: হূদরোগ বিশেষজ্ঞ বা হূদরোগ হাসপাতালে নয়। একজন স্ট্রোক বিশেষজ্ঞ রোগীকে পরীক্ষা করবেন। রোগীর সঠিক রোগ নির্ণয় করবেন। যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করবেন। রোগীর অন্যান্য রোগ নির্ণয় করবেন। সে সম্পকর্ীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন এবং তার চিকিৎসাও দেবেন। কারণ পূর্বেই উলেস্নখ করা হয়েছে, অন্য অনেক রোগের সাথে স্ট্রোকের সম্পর্ক থাকে। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় রোগীকে নিতে পারলে স্ট্রোকের বিশ্বমানের চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই দেয়া সম্ভব।
স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসার পর আসে রোগীকে পুনরায় সচল করে তোলা, যা সম্মিলিত থেরাপির মাধ্যমে করা সম্ভব। এর পরের প্রশ্ন, স্ট্রোক ও আনুসাঙ্গিক রোগের একটি সম্মন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা নির্ণয় ও প্রয়োগ করা। এর মধ্যে স্ট্রোক যাতে পুনরায় না হয় তার দিকে যথাযথ দৃষ্টি দেয়া। এর পর রোগীকে যতটা সম্ভব সুস্থ করে পারিবারিকভাবে পুনর্বাসন ও তার কার্যক্ষেত্রে পুনরায় ফিরে যেতে সাহায্য করা। মনে রাখবেন, কাজটি কিন্তু সহজ নয়। এ কাজে অনেক ধৈর্য্যের প্রয়োজন।
শেষ কথা: স্ট্রোক কি ভাল হয়ে যাবে:
১. আরোগ্য নির্ভর করে কত তাড়াতাড়ি রোগীকে চিকিৎসা ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে তার উপর
২. কত তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা কার্যক্রম ও ফিজিওথেরাপি দেয়া হচ্ছে
৩. আরোগ্যলাভ আরো নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোথায়, কত বড় এবং কোন ধরণের স্ট্রোক হয়েছে এবং রোগী আর কী কী রোগে ভুগছে
৪. যে সব রোগীর প্রথম থেকে আরোগ্যলাভ শুরু হয়, তাদের ক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় না হলেও প্রায় স্বাভাবিক কার্যক্ষম করে তোলা যায়
৫. অনেক ক্ষেত্রে রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্থ থেকেই জীবন কাটাতে বাধ্য হয়
৬. একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, একবার স্ট্রোক হলে পুনরায় তা হতে পারে
৭. যারা মৃতু্যবরণ করেন, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্ট্রোক পরবর্তী জটিলতার কারণেই মৃতু্যবরণ করেন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: ব্যক্তিগতভাবে আমি কয়েকটি পরিস্থিতিতে স্ট্রোক হতে দেখেছি। তারমধ্যে:-
০০ বয়ষ্কলোকের অত্যধিক মানসিক যন্ত্রণা
০০ শল্য চিকিৎসা-বিশেষ করে চোখের শল্য চিকিৎসার পর
০০ হূদযন্ত্রের ভেতর টিউমার
০০ অনেক চেষ্টা করেও স্ট্রোকের কারণ খুঁজে না পাওয়া (যদিও অনেক সময় সব ধরনের পরীক্ষা করা আমাদের দেশে সম্ভব হয়না বা অনেক উচ্চমানের পরীক্ষাগারে করেও সূত্র মিলানো যায় না)
০০ রোগী মানসিক রোগের উপসর্গ নিয়ে এসেছেন কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল, মস্তিষ্কে বিশাল স্ট্রোক হয়েছে। পরবর্তীতে এ রোগী মারাও গেছেন।
০০ একজন স্ট্রোক রোগীকে দেখেছি, যাকে তার আত্মীয়-স্বজনরা মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ ও হাসাহাসির কারণে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।
স্ট্রোকের রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে নিতে হবে, বিশেষ করে একজন স্নায়ুরোগ বা স্ট্রোক বিশেষজ্ঞের কাছে। ভুল করে বা অজ্ঞতা বশত: হূদরোগ বিশেষজ্ঞ হূদরোগ হাসপাতালে নয়।
প্রফেসর ডা: সিরাজুল হক