সৌদি আরব : উন্নয়নের এক শ’ বছর

১৩১৯ হিজরির ৫ শাওয়াল মোতাবেক ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ জানুয়ারি মরহুম বাদশাহ আবদুল আজিজ কর্তৃক রিয়াদ পুনর্দখলের দিন থেকে পরবর্তী এক শ’ বছরে সৌদি আরব অব্যাহত উন্নয়ন ও গঠনমূলক পরিবর্তনের এক বিস্ময়কর ঘটনাপুঞ্জি প্রত্যক্ষ করেছে। ঐতিহাসিক এই অবিস্মরণীয় বিজয়ের প্রথম কাáিক্ষত ফসল ছিল দ্বিধাবিভক্ত আরব উপদ্বীপকে একীভূতকরণের এক জটিল ও কঠিন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এবং পরে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠা। ইসলামি ঐতিহ্য ও মূলনীতির ভিত্তিতে একটি আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাদশাহ আবদুল আজিজ পরস্পরবিচ্ছিন্ন অশান্ত আরব উপদ্বীপে শান্তি ও স্খিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন এবং এই শান্তি ও স্খিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশকে তিনি সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে পরিচালিত করেন। যে সমাজ শত শত বছর কোনো পরিবর্তনের মুখ দেখেনি এবং পুরনো কৃষিপদ্ধতি ও খুব সীমিত ব্যবসার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারত না সেই সমাজটি আজ কৃষি, শিল্প, স্বাস্খ্য ও আধুনিক জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের একটি মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত এক শ’ বছরে সৌদি আরব একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বসমাজে নিজের জন্য একটি সম্মানজনক স্খান করে নিতে পেরেছে। বর্তমানে এই দেশটি বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে শান্তি ও সহযোগিতার বাণী প্রচার এবং সঙ্কটে মধ্যস্খতাকারী হিসেবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ
উন্নয়নের পথে সৌদি আরবের অব্যাহত অগ্রগতি একটি প্রণিধানযোগ্য ও উল্লেখযোগ্য বাস্তবতা। গোটা বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত ও দক্ষতার সাথে বাস্তবায়িত। বাদশাহ আবদুল আজিজ ও তার উত্তরসূরি পুত্রদের­ সউদ, ফয়সল, খালিদ ও ফাহাদ­ সবাই একটি অতি সাধারণ নীতি অনুসরণ করে এসেছেন। তা হলো, জনগণই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং সরকারের কর্তব্য সব সেবা ও সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্য সুলভ করে দেয়া­ যেন তারা নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। অতীতে হাজীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফি সৌদি আরবের পশ্চিম অংশ হিজাজের শাসকদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। ১৯২৬ সালে হিজাজ দখলে আসার পর বাদশাহ আবদুল আজিজ এই মূল নীতি তৈরি করলেন যে, সৌদি আরব হাজীদের সেবা করবে এবং সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার হাজীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে না। সৌভাগ্যক্রমে, সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে খননকাজের ফলে দেশটির পূর্বাঞ্চলে তেলের বিপুল মজুদ আবিষ্কৃত হয়। আবিষ্কৃত তেলের এই বিপুল মজুদ সৌদি আরবের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করে। সৌদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনাবিদরা প্রাপ্ত তেলের এ বিপুল ভাণ্ডারকে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করলেন এবং একে উন্নয়নের অন্যান্য খাতের মূলধন হিসেবে কাজে লাগালেন, যাতে একদিন এসব খাতও তেল খাতের মতো অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎসে উন্নীত হতে পারে। জাতীয় তেল কোম্পানি ‘আরামকো’ তেল খাতের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে উৎপাদন, পরিশোধন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের এক বিরাট ও ব্যাপকভিত্তিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। সৌদি উন্নয়ন পরিকল্পনার সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় জাতীয় সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি অর্জনের জন্য এবং একটি সফল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপন্ন ও সেবার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়া। এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হলো আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানির সক্ষমতা অর্জন করা।
পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পরবর্তী চার দশক উল্লিখিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের পর সৌদি আরব উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অতিক্রম করে। ১৯৭০ সাল থেকে দেশে পঞ্চ-বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উন্নততর পর্যায়ে প্রবেশ করে। উন্নয়নের পথে সমন্বয়, ধারাবাহিকতা ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে গৃহীত প্রতিটি পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনাই ছিল পরবর্তীটির ভিত্তি। অবশ্য আশি ও নব্বইয়ের দশকের পরবর্তী পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য নির্ধারিত হয় জাতীয় অর্থনীতির বহুমুখীকরণ ও বেসরকারীকরণ। বেসরকারি খাতের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্যে বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠান স্খাপন করলেন, যার লক্ষ্য ছিল শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিনিয়োগ সুবিধার সৃষ্টি।
উন্নয়নের এক শ’ বছর
বিদ্যমান খাতগুলোকে সম্প্রসারিত করার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা ও কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়। ১৯৯৭ সাল নাগাদ এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি খাতে ৭২.৮ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক প্রদান করে। এগুলোসহ অন্যান্য কর্মসূচির ফলে ১৯৭০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত সময়ে সৌদি আরবের মোট স্খানীয় উৎপাদন (জিডিপি) সাত গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪৪.৮২ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল বা ১৪৫.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। একই সময়কালে জিডিপিতে তেলবহির্ভূত খাতের অংশ ৪১.১ থেকে ৬৫.২%-এ উন্নীত হয়। একবিংশ শতাব্দীতে অর্জিত আর্থসামাজিক অগ্রগতির এই ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য শিক্ষা খাতে দেশটির ব্যাপক বিনিয়োগ প্রয়োজন। ১৯৩২ সালে আধুনিক সৌদি আরব প্রতিষ্ঠালগ্নে সাধারণ শিক্ষা বলতে ছিল শহর এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্খাপিত কিছুসংখ্যক ধর্মীয় শিক্ষালয়। বর্তমানে সৌদি আরবের আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০টিরও অধিক ফ্যাকাল্টিতে এবং ২২ হাজার ৩০০ বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ সম্পূর্ণ অবৈতনিক। এই সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বর্তমানে ৪৫ লাখের অধিক।
অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি
জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সৌদি আরবে অনুরূপ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সৌদি আরবে ১৯৩২ সালে চিকিৎসাসেবা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সেখানে বর্তমানে দেশটিতে আধুনিক চিকিৎসাসেবার সব সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি বিদ্যমান। শিল্পের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দেশটিতে বর্তমানে শিল্পকারখানার সংখ্যা তিন হাজার ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। যেগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা দুই লাখ ৮০ হাজার। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ও রফতানির জন্য এসব কারখানায় বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদিত হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রতি বছর বিশ্বের ১১৮টি দেশে প্রায় ২৩ বিলিয়ন রিয়াল বা ৬.১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সৌদি উৎপাদিত দ্রব্য রফতানি করা হয়। যোগাযোগের জন্য দেশটিতে রয়েছে হাজার হাজার মাইলের সেকেন্ডারি রোড, একাধিক সমুদ্রবন্দর এবং বহুসংখ্যক বিমানবন্দর। সৌদি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে দেশের পানিসম্পদ উন্নয়ন এবং কৃষি, শিল্প ও নাগরিকদের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য পানি সরবরাহ বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বর্তমানে দেশটিতে রয়েছে ১৮৪টি বাঁধ­ যেগুলোর মোট পানি ধারণক্ষমতা ২৭.৩ বিলিয়ন ঘনফুট। তা ছাড়া রয়েছে প্রতিদিন ৫২০ মিলিয়ন গ্যালন পানীয়জল সরবরাহের জন্য ৩৩টি লবণ-বিমুক্তকরণ কারখানা। কৃষি খাতই হচ্ছে সৌদি আরবে পানি ব্যবহারের সর্ববৃহৎ খাত­ বর্তমানে যার বার্ষিক উৎপাদন ৩০ লাখ টন শস্যদানা, ২৫ লাখ ৯০ হাজার টন সবজি, ১১ লাখ ৫০ হাজার টন ফল, তিন লাখ ৯৭ হাজার টন হাঁসমুরগি, ১৫৭ হাজার টন লাল গোশত এবং আট লাখ ১৬ হাজার টন গবাদিপশুজাত উৎপন্ন দ্রব্য।
প্রভাবশালী বিশ্বশক্তি
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সৌদি আরব বর্তমানে একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সৌদি আরবের গুরুত্বের অন্যতম কারণ ইসলামের জন্মস্খান এবং দুই পবিত্র স্খান মক্কা মুকাররামা ও মদিনা মুনাওয়ারার দেশ হিসেবে বিশ্বের ১০০ কোটি মুসলমানের মধ্যে দেশটির বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্খান। অন্য দু’টি কারণের একটি হলো সৌদি সরকারের স্খিতিশীলতা ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং অপরটি প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশের সাথে দেশটির বìধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ইসলামি মূলনীতি ও সমৃদ্ধ আরবীয় ঐতিহ্যের ধারক সৌদি আরব বিশ্বের দরবারে সঠিকভাবেই তার মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ, আরব লিগ, ওআইসি, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্খার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সৌদি আরব মানবজাতির অব্যাহত উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য নিরলস দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। লেবানন, আফগানিস্তান ও বসনিয়ায় শান্তি স্খাপনসহ বিশ্বের অনেক সঙ্কট নিরসনে সৌদি আরব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আরব-ইসরাইল সমস্যা সমাধান এবং কুয়েতকে ইরাকি আগ্রাসনমুক্ত করার ক্ষেত্রেও সৌদি আরব উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। তা ছাড়া মানুষের সৃষ্ট বিপদ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মনুষ্যসমাজকে রক্ষার জন্য বরাবর অকাতরে অর্থসম্পদ ব্যয় করে আসছে ও জনসম্পদকে কাজে লাগিয়ে এসেছে। অন্যান্য দেশের উন্নয়ন সহায়তায় সৌদি আরব এ পর্যন্ত ৮ হাজার কোটি ডলারেরও অধিক সাহায্য প্রদান করেছে।