ফিস্টুলা : কারণ ও চিকিৎসা

ফিস্টুলা বা ভগন্দর চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদি থেকেই ডাক্তারদের কাছে পরিচিত। ফিস্টুলার বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। নালীটি মলদ্বারের কোন কোন স্তর ভেদ করেছে বা কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে মূলত তার ওপর নির্ভর করছে এর জটিলতা। বিভিন্ন ধরনের ফিস্টুলার চিকিৎসার জন্য রয়েছে বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি। রোগীদের ধারণা, আমাদের দেশে ফিস্টুলা হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। শতকরা হার আমি বলতে পারব না। যার কারণে রোগীরা অপারেশনের কথা শুনলেই বলেন, স্যার দেখুন বিনা অপারেশনে করতে পারবেন কি না। কারণ অপারেশন আর কত করবেন এটি তো আবার হবেই। কিছু রোগী পেয়েছি যাদের দুই-তিনবার এমনকি পাঁচবার পর্যন্ত অপারেশন হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ আবার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফিস্টুলার কারণ কী এবং কী করে হয়?
এ রোগটির উৎপত্তি হয় মলদ্বারের বিশেষ ধরনের সংক্রমণের কারণে। মলদ্বারের ভেতরে অনেক গ্রন্থি রয়েছে, এগুলোর সংক্রমণের কারণে ফোড়া হয়। এই ফোড়া এক সময় ফেটে গিয়ে মলদ্বারের চতুর্দিকের কোনো এক স্খানে একটি ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসে এবং পুঁজ নির্গত হতে থাকে। এ সংক্রমণের কারণে মলদ্বারে প্রচুর ব্যথা হয়। রোগী সারা দিন ব্যথায় কাতরাতে থাকে। পুঁজ বের হওয়ার পর ব্যথা কমতে থাকে। মলদ্বারের পার্শ্বস্খিত কোনো স্খানে এক বা একাধিক মুখ দিয়ে মাঝে মধ্যে পুঁজ বের হয়ে আসাকে আমরা ফিস্টুলা বা ভগন্দর বলি। সাধারণ লোকের ধারণা, কৃমির বাসা থেকে এর উৎপত্তি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এ ধারণাটি একেবারেই অমূলক বলে প্রমাণিত হয়েছে। মলদ্বারের ক্যান্সার এবং বৃহদান্ত্রের প্রদাহজনিত রোগেও ফিস্টুলা হয়ে থাকে। মলদ্বারে যক্ষ্মার কারণেও ফিস্টুলা হতে পারে।
ফিস্টুলা কত প্রকার?
এটিকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন­ ১. সাধারণ, ২. মাঝারি জটিল ৩. অত্যন্ত জটিল।
সাধারণ ফিস্টুলা : এটি মলদ্বারের মাংসপেশির খুব গভীরে প্রবেশ করে না বিধায় চিকিৎসা সহজসাধ্য।
জটিল ফিস্টুলা : এর বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে এবং তা নির্ভর করে এর নালীটি মলদ্বারের মাংসের কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে এবং কতটা বìধুর পথ পাড়ি দিয়ে এটি বাইরের মুখ পর্যন্ত এসেছে। এগুলোর চিকিৎসা সত্যিকার দু:সাধ্য। তারপর যদি এ নালী একের অধিক হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। এ রোগের অপারেশনে প্রধান প্রতিবìধকতা হলো সঠিকভাবে অপারেশন সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে রোগী মল আটকে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে।
ফিস্টুলা বা ভগন্দরের উপসর্গ কী কী?
এ রোগের লক্ষণ মূলত তিনটি : ১. ফুলে যাওয়া ২. ব্যথা হওয়া এবং ৩. নি:সরণ বা পুঁজ ও আঠালো পদার্থ বের হওয়া।
বেশির ভাগ রোগীই আগে মলদ্বারে ফোড়া হয়েছিল বলে জানান। ভেতরে ফোড়া হওয়ার জন্য ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়। যখন এগুলো ফেটে মুখ দিয়ে কিছুটা পুঁজ বের হয়ে যায় তখন ব্যথা এবং ফুলা কমে যায়। নি:সরণ বা পুঁজ পড়া মাঝে মধ্যে হয়। কখনো কখনোই দুই-চার মাস এটি সুপ্ত থাকে। কখনো কখনো মলের সাথে পুঁজ ও আম পড়তে থাকে। সমস্যা একটানা না থাকার কারণে রোগীরা অনেক সময় ভাবেন যে, বোধ হয় সেরে গেছে। এ কারণে বিভিন্ন ধরনের টোটকা ওষুধ বা হোমিওপ্যাথি খেয়ে মনে করেন, সম্ভবত ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু দু-চার মাস পর আবার যখন এই সমস্যা দেখা দেয় তখন আবার আমাদের কাছে এসে বলেন, স্যার এখন কী করা যায়?
চিকিৎসা কী?
৯০ শতাংশ পাইলস রোগীর কোনো অপারেশন দরকার নেই, আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে ব্যথা ও অপারেশন ছাড়া এর চিকিৎসা করা সম্ভব। কিন্তু এই রোগে ১০০ ভাগ রোগীর অপারেশন দরকার। ফিস্টুলা বা ভগন্দর থেকে যখন পুঁজ পড়ে বা ব্যথা করে, তখন রোগী অপারেশন করতে রাজি হন। অভিজ্ঞ সার্জনরা বলে থাকেন, ফিস্টুলা অপারেশনের সমস্যা নিয়ে সার্জনদের যত বদনাম হয়েছে, অন্য কোনো অপারেশনের বেলায় ততটা হয়নি। এজন্য এই অপারেশন করতে সার্জনের এ বিষয়ে বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ ও ব্যুৎপত্তি থাকা উচিত। অপারেশনের আগে বৃহদান্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ বা রেকটাম ক্যান্সার বা মলাশয়ের যক্ষ্মা আছে কি না অবশ্যই পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। এ অপারেশনে দুই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ১. ভগন্দরের নালীটি কেটে ভেতরের পথটি খুলে দিতে হয় ২. ভগন্দরের নালীটি আগাগোড়া কেটে উপড়ে ফেলে দিতে হয়।
অপারেশন-পরবর্তী পরিচর্যা
অপারেশনের পর মলদ্বারের ভেতর কোনো পাইপ দেখার প্রয়োজন নেই। ছয় ঘন্টা পর স্বাভাবিক খাবার দেয়া যায়। ক্ষতস্খানটি ড্রেসিং করে সব সময় পরিষ্কার করে রাখা হবে। সাত দিন পরপর ডাক্তারের চেম্বারে আসা উচিত। যত দিন পর্যন্ত ঘা না শুকায় তত দিন প্রতিদিন দু-তিন বার ঢ়ময়্ দথয়ভ বা ভমহ দথয়ভ দেয়া উচিত। গরম পানিতে লবণ দিয়ে কোমর ডুবিয়ে মলদ্বারে ছেঁকা দিতে হয়।
ঝমশহলপ বা সাধারণ ফিস্টুলার ক্ষেত্রে দু-এক দিন পর হাসপাতাল থেকে ছুটি দেয়া যায়। জটিল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়। ক্ষত শুকাতে সাধারণত ৪ থেকে ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত লাগে। জটিল ফিস্টুলার আবার শ্রেণীভেদ আছে। ভিন্ন ভিন্ন জটিল ফিস্টুলা আবার বিশেষ পদ্ধতি ও প্রযুক্তি প্রয়োগে অপারেশন করতে হয়।
লেখক : বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : জাপান-বাংলাদেশ ফেন্সন্ডশিপ হাসপাতাল,
৫৫, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা।
ফোন : ০১৭১৫০৮৭৬৬১, ০১৭২৬৭০৩১১৬