কেউ বলেন চিন্তা, কেউ বলেন দুশ্চিন্তা, কেউ বলেন টেনশন, কেউ বলেন পেরেশান, কেউ বলেন মানসিক যন্ত্রণা আবার কেউ বা বলেন ডিপ্রেশন, কেউ বলেন ব্যাধির শিকড় আবার কেউ বলেন রাবণের চিতা, যা নিভতে চায় না যতক্ষণ নিজে চিতায় না ওঠা যায়।
যেকোনো ব্যক্তিকে যখনই কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় তখনই একটা উত্তর মুখে লেগেই আছে তা হল প্রোবলেম (সমস্যা) সমস্যা আর সমস্যা। অন্য গ্রহের লোকেরা নাকি পৃথিবীতে বেড়াতে এসে বলে, পৃথিবীর মানুষেরা বেশি সুবিধার নয়, কারণ নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সৃষ্টি করে আবার ওই সমস্যার জন্য নানান অজুহাত তৈরি করে। চিন্তার জন্মদাতা মানুষ নিজেই।
ডায়রিয়া থেকে পাইওরিয়া, অম্লপিত্ত থেকে মধুমেহ, ব্লাড প্রেসার থেকে হার্ট অ্যাটাক ও চুলকানি থেকে ক্যান্সার সব রোগের জন্মদাতা এই দুশ্চিন্তা বা চিন্তা।
চিন্তা বা মানসিক চাপ হৃদরোগের একটি বড় কারণ। বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি হৃদরোগ। কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই যেকোনো সময় এটি কেড়ে নিতে পারে মানুষের জীবন। বিশ্বের মোট মৃত্যুর অর্ধেকই হয় হার্টের রোগ ও স্ট্রোকে।
প্রতি বছর লাখ লাখ লোকের হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। এদের মধ্যে ২৫ ভাগের মৃত্যু হয় হাসপাতালে পৌঁছার আগেই। হার্ট অ্যাটাক হয়েও অনেক সময় বেঁচে থাকতে হয় নানা অক্ষমতা আর হঠাৎ মৃত্যুর ভয় নিয়ে। বর্তমানে আমাদের জীবনধারায় পশ্চিমা ধাঁচে পরিবর্তন হচ্ছে। ফাস্টফুডের সাথে দ্রুততালে বাড়ছে ফ্যাট খাওয়ার প্রবণতা। কমেছে শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস ও টাটকা খাবার খাওয়ার ঝোঁক।
জীবনের গতি বাড়তে বাড়তে জেটগতির জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পরেছে একশ্রেণীর মানুষ। ফলে ইঁদুর-দৌড়ের জীবনে বাড়ছে টেনশন, মানসিক চাপ মনে হয়ে পড়ছে ক্ষতবিক্ষত হৃদরোগ, বেড়ে চলছে এভাবে। অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে চলছে ধূমপান। এর বিপক্ষে সচেতনতা সৃষ্টি ও মোটিভেশনও যেন রুখতে পারছে না এর অগ্রযাত্রাকে। ধূমপান এখন আর শুধু বড়দের সঙ্গী নয়, ছোটদেরও বìধু। অতীতে বাঙালি ছিল কর্মমুখর, পরিশ্রম-নির্ভরতায় চলছিল জীবন। জীবনযাপনের এ পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে মানুষ। গ্রামের একশ্রেণীর মানুষ এখন মোটরসাইকেলে চড়েন বেশি, সাইকেলে চড়েন কম, হাঁটেন আরো কম। শহরাঞ্চলে লাফ দিয়ে বাড়ছে গাড়ি চড়া, বসে বসে কাজ করা ও আয়েশী জীবনযাপনের মানসিকতা। কমছে শরীরের ব্যায়াম, বাড়ছে স্খুলতা।
উন্নত বিশ্বে বিজ্ঞানীরা হৃদরোগের বিকল্প পদ্ধতিতে চিকিৎসার গবেষণা করেই চলছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, বিকল্প পদ্ধতিতে জীবনধারা ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারলে সেটা হৃদরোগের ঊর্ধ্বগতি থামিয়ে দেয়। একই সাথে রুদ্ধ ধমনীগুলোও (ব্লকেজ) খুলে যায়।
করোনারি আর্টারি ডিজিজ এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত ব্যাধি। বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই রোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে : বংশানুক্রমিক ধারা (অর্থাৎ পিতা-মাতার হৃদরোগ থাকলে), উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল, ধূমপান ইত্যাদি। ব্যক্তির জীবনযাপন এবং মানসিক অবস্খাও সমভাবে গুরুত্ব বহন করে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে। প্রতিকূল পরিস্খিতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ যুবা বয়সে হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ।
প্রচলিত চিকিৎসা
হৃদরোগ চিকিৎসায় বর্তমানে যে পদ্ধতিটি বহুল ব্যবহৃত সেটি হলো হৃদযন্ত্রের ধমনীকে প্রসারিত করে তার ভেতরে রক্ত সঞ্চালন করা এবং হৃদযন্ত্রের পেশিতে অক্সিজেনবাহিত রক্তের প্রয়োজন হন্সাস করা। সার্জিক্যাল চিকিৎসায় সঙ্কীর্ণ ধমনীতে রক্ত সঞ্চালনের বিকল্প পথ তৈরি অথবা বেলুন প্রবেশের মাধ্যমে সেই পথ প্রসারিত করা হয়। এসব রোগীকে সাময়িক উপশম দেয় বটে কিন্তু এর কোনোটিই হৃদরোগের মূল সমস্যার সাথে সম্পর্কিত নয়।
বিকল্প চিকিৎসা
এটা প্রমাণিত যে, এই পদ্ধতি গ্রহণে হৃদরোগ ভালো হতে শুরু করে এবং জীবনধারায় পরিবর্তন এনে রোগের মাত্রা থামিয়ে দেয়া যায়। এসব পরিবর্তনের ভেতরে রয়েছে : মেদযুক্ত খাদ্য পরিহার, অত্যন্ত স্বল্প মেদযুক্ত আহার গ্রহণ; ধূমপান বর্জন, মনোদৈহিক চাপ ব্যবস্খাপনা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, মেডিটেশন ও মনোসামাজিক সহায়তা দান। অনেকেই জানেন না, বাইপাস সার্জারি/এনজিওপ্লাস্টি করা হরেও পাঁচ বছরের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ওইসব ধমনীর শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত ব্লকড হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া এনজিওপ্লাস্টি করা ধমনী ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত আবারো রুদ্ধ হয়ে যায় চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে পুনরায় বাইপাস সার্জারি ও এনজিওপ্লাস্টি করা জরুরি হয়ে পড়ে। একটার সাথে যুক্ত আরেকটা রোগ, হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে স্বল্প ব্যয়ের এই বিকল্প পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের এই বিকল্প চিকিৎসা প্রোগ্রামে রয়েছে :
ডায়েট কাউন্সেলিং বা পরামর্শ অনুযায়ী খাবার গ্রহণ
নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিট হাঁটা, প্রাণায়াম, যোগ ব্যায়াম
গভীর প্রশান্তির জন্য চাপ গ্রহণ ও চাপমুক্তির ব্যায়াম
মেডিটেশন এবং দৃশ্যমান ইমেজারি
অনুভূতি ভাগাভাগির ওপর জোর দিয়ে গ্রুপ আলোচনা।
খাদ্যাভাসের পরিবর্তন, প্রাণায়াম, মেডিটেশনের পাশাপাশি অপারেশন ছাড়াই হৃদরোগ প্রতিরোধে আরো একটি পদ্ধতি বায়োকেমিক্যাল এনজিওপ্লাস্টি বা চিলেশন থেরাপি : হৃদযন্ত্রের ধমনীর ব্লক অপসারণ সম্ভব বায়োকেমিক্যাল মিশ্রণের মাধ্যমে। বর্তমানে উন্নত বিশ্বের এ পদ্ধতির চিকিৎসা অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
জীবনে চলার পথে যা ঘটার তাই ঘটে। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক তাকে স্বীকার করে নেয়াই মহত্ত্বের লক্ষণ। কোনো ঘটনা জানিয়ে আসে আবার কোনো ঘটনা না জানিয়ে আসে। কোনোটা ইতিবাচক, কোনোটা নেতিবাচক। কখনো প্রেরণাদায়ক, কখনো বেদনাদায়ক। কখনো ঘটনা জীবনকে প্রভাবিত করে, কখনো হতাশা এনে দেয়। অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে সব ঘটনার পেছনে এক কল্যাণকারী ছায়া আছে, যাকে অনুধাবন করতে পারলে ভবিষ্যতে কায়ারূপে অর্থাৎ সাকাররূপে মঙ্গলময় হয়। তাই ঘটনা পেছনে না দৌড়ে, দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সময় ও মনের শান্তিকে সাশ্রয় করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
আত্মিক উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন ঘটানোর নাম মেডিটেশন (ধ্যান)। দেহ ও মনের সুস্খতা ও সুরক্ষায় এর বিকল্প নেই। মেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা নেই এমন সব রোগ থেকে দূরে থাকা যায়, এমনকি সেসব রোগ থেকে রক্ষাও পাওয়া যায়।
লেখক : কনসালটেন্ট
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল
মোবাইল : ০১৭১১৫৯৪২২৮