ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত ভাইরাস রোগ। চার ধরনের ভাইরাসে এ রোগ হয়। প্রথমত, ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ওই ভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, ৭-৮ মাসের জন্য দ্বিতীয় কোনও ভাইরাসও আক্রমণ করে না। তবে দ্বিতীয়বার ইনফেকশন হলে সাধারণত মারাÍক ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হয়। সেজন্যই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের রোগীর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ে।
উপসর্গ : চিকিৎসার সুবিধার জন্য ডেঙ্গুকে তিন ভাগে বর্ণনা করা হয়। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রম। আরও দুইভাবে ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসার জন্য আসে। নন-স্পেসিফিক ফিভার যেসব ডেঙ্গুজ্বরকে অন্য জ্বর থেকে পৃথক করা সম্ভব হয় না। ডেঙ্গুর জটিলতা লিভারের মারাÍক অসুখ (ফালমিনেটিং লিভার ফেইলুর) অথবা ব্রেনের অসুখ (এনসেফালাইটিস/ এনসেফালপ্যাথি)। ডেঙ্গুতে এনসেফালাইটিস হয় না বললেই চলে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর এ সময় জ্বর যে কোনও কারণেই হোক ডেঙ্গু ভেবে চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে।
মশা কামড়ানোর দুই সপ্তাহ পরে জ্বর হলে বা দুই সপ্তাহের বেশি জ্বর থাকলে সেটা ডেঙ্গু নয়। ডেঙ্গুরও তিনটি উপসর্গ লক্ষণীয়। জ্বর, রক্তক্ষরণ এবং র্যাশ। ডেঙ্গুতে হঠাৎ করেই সব উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন রোগীর ভীষণ জ্বর, অসহনীয় গা-ব্যথা, গিরাব্যথা, মাথাধরা, বমি, র্যাশ বেরোয়। ১০৪০ থেকে ১০৬০ ফা. জ্বর পাওয়া যায়। ডেঙ্গুর র্যাশ চার ধরনের। প্রথম দিন বা দ্বিতীয় দিন সারা শরীর লাল (ফ্লাস) হয়ে যায়, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তাভ দানা (ফ্লিটিং র্যাশ) দেখা যায়। তৃতীয় বা চতুর্থ দিনের হামের মতো র্যাশ (মরবিলি ফরম) উঠতে পারে। টিপিক্যাল র্যাশ বেরোয় ষষ্ঠ দিনে। পিনের মাথার আকৃতির রক্তদানার মতো সারাশরীরে র্যাশ ছড়িয়ে যায় এবং এর মাঝে মাঝে স্বাভাবিক চামড়া দেখা যায়। একে বলে কনভালোসেন্ট কনফ্লুয়েন্ট পেটিকিয়াল র্যাশ। র্যাশ ছাড়াও ডেঙ্গু হতে পারে। হেমোরেজিক না হয়েও র্যাশের সঙ্গে রক্তক্ষরণ থাকতে পারে ক্লাসিক ডেঙ্গুতে। ডেঙ্গুজ্বরের সময় অনেক মহিলাই অসময়ে মাসিক শুরু হওয়ার কথা বলেছে যাদের ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ছিল, তাদের ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হয়নি। ডেঙ্গুতে রক্তনালী লিক করে ও রক্তক্ষরণ বন্ধের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
রক্তনালীর লিকই আসলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের মূল সমস্যা। এজন্যই ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণ ছাড়াও রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার কমে যায়, পেটে পানি (এসাইটিস) ও ফুসফুসে পানি (ইফুশন) জমে। এসব লক্ষণ সাধারণত জ্বর চলে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে শুরু করে ৪৮ ঘণ্টা পর পর্যন্ত হয়ে থাকে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে দৃশত কোনও রক্তক্ষরণ না থাকলে তাকে গ্রেড-১ বলে। রক্তক্ষরণ থাকলে গ্রেড-২। এগুলোর সঙ্গে রক্তচাপ কমতে থাকলে বলে গ্রেড-৩, আর রক্তচাপ না পাওয়া গেলে গ্রেড-৪। গ্রেড-৩ ও গ্রেড-৪ কে একত্রে ডেঙ্গু শক সিনড্রম বলে।
প্রতিকার : ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে তিনটি মারাÍক সমস্যা দেখা দেয় ১. রক্তক্ষরণ ২. লিভার ফেইলুর ও ৩. শক। রক্তক্ষরণ বিশেষ করে খাদ্যনালীর রক্তক্ষরণ (রক্তবমি, কালো পায়খানা) ও হেপাটিক ফেইলুর এবং অনেক ক্ষেত্রে কিডনি ফেইলুর ওইসব রোগীর বেশি হয় যারা নিমেসুলাইড (নিমো, নীরা ইত্যাদি) ডাইক্লোফেন (ভলটালিন ইত্যাদি) জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের অনেক চিকিৎসক এখনও জ্বর কমানোর জন্য এসব ব্যবহার করে থাকেন। ডিহাইড্রেশনের রোগীর ক্ষেত্রে এগুলোর ব্যবহার মারাÍক পরিণতিকে ত্বরান্বিত করে। ডেঙ্গুর বিশেষ কোনও চিকিৎসা নেই। শক প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পানি খেতে হবে। জ্বরের জন্য উল্লিখিত ওষুধগুলো ব্যবহার না করে প্যারাসিটামল (৬০-৮০ মি.গ্রাম/কেজি/প্রতিদিন) দিতে হয়। জ্বর স্বাভাবিক না হলেও ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট রাখতে পারলেই হবে। প্যারাসিটামল সাধারণত ৫০০ মি.গ্রাম করে ৬ ঘণ্টা পর পর খেলেই চলে; তারপরও যদি জ্বর ১০২০-র বেশি থাকে তবে অতিরিক্ত ৫০০-১০০০ মি.গ্রাম তৎক্ষণাৎ খেতে হবে। অধৈর্য না হয়ে যথোপযুক্ত পরিমাণ প্যারাসিটামল ও পানি দিলে সব রোগীরই জ্বর কমে। প্রতিদিন মোটামুটি ৩ লিটার পানি খেতে পারলেই হবে। পানি খেতে না পারলে স্যালাইন দিতে হবেÑ এক্ষেত্রে নরমাল স্যালাইনই সবচেয়ে ভালো। নিউট্রিশন ঠিক রাখার জন্য অন্যান্য খাবার খেতে উৎসাহী করতে হবে। ডাবের পানি, ওরস্যালাইন, জুস, কোক ইত্যাদি পানীয় দিলে পানির সঙ্গে ক্যালরিও নিশ্চিত হয়। ডেঙ্গু শক প্রতিরোধ করতে হলে ব্লাড প্রেসার, প্রস্রাবের পরিমাণ ইত্যাদি মনিটর করতে হবে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে মৃতের সংখ্যা ১০-১২ শতাংশ হতে পারে। শক সিনড্রম হলে এ সংখ্যা ৪০ শতাংশে দাঁড়াবে। তবে প্রথম থেকেই উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে পারলে এ সংখ্যা ০.২ শতাংশ রাখা সম্ভব। থাইল্যান্ডে মৃতের সংখ্যা ০.২ শতাংশ রাখতে পারলেও ভারত, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুরের মৃতের সংখ্যা ২ এর বেশি। গত কয়েক বছর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমাদের মৃতের সংখ্যা ২-এর কম এবং কমছে।
খারাপ দেখলে রোগীকে ভালো হাসপাতালে আনাই সর্বোত্তম। যার পেটের ব্যথা থাকছেই, বমি কমছে না, যে উল্টা-পাল্টা বকছে এ ধরনের রোগী ডেঙ্গু শক সিনড্রম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব রোগীর হঠাৎ করে জ্বর নেমে যায় ও প্লাটিলেট খুব কমে যায়।
গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ তে বিশেষ কিছু লাগার কথা নয়। গ্রেড-৩ হলে স্যালাইন দিয়ে মনিটর করতে হবে। প্রথমে তিন মিলি/কেজি/ঘণ্টা দিয়ে শুরু করে প্রয়োজন অনুযায়ী (প্রেসার দেখে) কমাতে বা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে বেশি পানি দেয়াও মারাÍক ঝুঁকিপূর্ণ। ডেঙ্গুতে রক্তনালীর (প্লাজমা) লিকের জন্য ডিহাইড্রেশন হয় এবং পানি লাগে। লিকটা ক্ষণস্থায়ী হয় ১২-৪৮ ঘণ্টা। লিক বন্ধ হয়ে গেলে তাই অতিরিক্ত পানি পেলে সেটা পেট, ফুসফুস, ব্রেন বা অন্যান্য জায়গায় জমবে। রক্তক্ষরণের জন্য হেমাটোক্রিট কমে গেলে পুরা (হোল) ব্লাড দিতে হবে। আশংকাজনক রক্তক্ষরণ থাকলে ও হিমাটোক্রিট বেশি থাকলে প্লাটিলেট দিতে হয়। অনেকে প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজার-এর কম হলে দিতে বলেন কারণ এসব ক্ষেত্রে ব্রেন বা অন্য কোনও ভাইটাল অর্গানে রক্তক্ষরণ হওয়ার ভয় থাকে। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ডেঙ্গুজ্বর চিকিৎসায় প্লাটিলেট দেয়ার প্রয়োজন প্রায় ক্ষেত্রেই নেই।
অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দীন
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, বারডেম