ভোর রাতে মুহুর্মুহু গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়

"ওইদিন ভোর রাতে মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শ্বাশুড়ি (আমেনা সেরনিয়াবাত) শ্বশুরকে (আব্দুর রব সেরনিয়াবাত) বলছিলেন, 'বাসায় ডাকাত পড়েছে।' এর উত্তরে শ্বশুর বলেন, 'মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাত পড়ে না। মনে হয়, আর্মি আক্রমণ করেছে।"

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে এভাবেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘটনার বর্ণনা দেন ওই রাতে বেঁচে যাওয়া শাহান-আরা-আব্দুল্লাহ। তিনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী।

বুধবার তিনি বলেন, "এ সময় আমরা সবাই শ্বশুরের রুমে চলে যাই। বাড়ির কাজের বুয়া লক্ষ্মীর মা বিপদ বুঝতে পেরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পরই দরজা ভেঙে ভেতর ঢুকে পড়ে বেশ কিছু সেনা সদস্য। আমাদের সবাইকে নিচের রুমে এনে ব্রাশফায়ার করলো।"


পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট খুনিরা প্রথমে আক্রমণ করে ২৭ মিন্টো রোডে, সেরনিয়াবাতের বাড়িতে। ভোররাত সোয়া ৫টার দিকে মেজর ডালিমের নেতৃত্বে ওই বাড়িতে হামলা চালানো হয়।

হত্যা করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ১০ বছরের ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, চার বছরের নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে), ভাতিজা সাংবাদিক ও অ্যাডভোকেট শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নাইম খান রিন্টুসহ কয়েকজন।

শাহান-আরা- আব্দুল্লাহ বলেন, "একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পঁচাত্তরের ১০ আগস্ট আমরা বরিশাল থেকে এসেছিলাম। ১৫ আগস্ট ভোররাতে সবাইকে এক সঙ্গে দাঁড় করিয়ে যখন ব্রাশ ফায়ার করা হলো, তখন আমার চার বছরের ছেলে বাবু ছিল শহীদ সেরনিয়াবাতের কোলে। আর আমার কোলে ছিল ১০ মাস বয়সী ছেলে সাদেক আব্দুল্লাহ ।"

"চোখের সামনে দেখলাম, শহীদের শরীর গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গেল। আমার আদরের ছেলে বাবুসহ উপুড় হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। পর মুহুর্তে গুলি লাগে আমার শরীরে। আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি।"

শাহান-আরা- আব্দুল্লাহর ধারণা, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ মনে করেই গুলি করা হয় শহীদ সেরনিয়াবাতকে।

তিনি জানান, হামলার পর রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিহত-আহত সবাইকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

কান্না বিজড়িত কন্ঠে শাহান-আরা বলেন, "আমার শরীরে চারটা গুলি লেগেছিল। হাসপাতালে ঢোকার সময় দেখি গাড়ি থেকে মণি ভাইয়ের লাশ নামানো হচ্ছে। কিছুদিন হাসপাতালে ছিলাম। সেখান থেকে কিছুদিন সোবহানবাগে খালা শ্বাশুড়ির (খাদিজা হোসেন, বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন) বাড়িতে ছিলাম। পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় '৭৬ সালের ১২ ফেব্র"য়ারি আমরা বরিশাল চলে যাই। কিন্তু সেখানেও নিরাপদ না হওয়ায় ভারতে চলে গিয়েছিলাম।"

"আমার শাশুড়ি শরীরে গুলির অংশ নিয়ে দীর্ঘ দিন নিদারুন যন্ত্রনা ভোগ করে তিন বছর আগে মারা গেছেন। আমরা যারা বেঁচে আছি, এখনো বুকের গভীরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যতদিন না খুনিরা শাস্তি পাবে, ততদিন এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না।"