বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল জীবন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে।

তৃতীয় সন্তান মুজিবকে খোকা বলে ডাকতেন শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সায়রা বেগম দম্পতি।

৭ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেন তিনি। দুই বছর পর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে মিশনারি স্কুলে।

কিন্তু ১২ বছর বয়সে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে তার লেখাপড়ায় সাময়িক বিরতি ঘটে। চার বছর পর আবার স্কুলে ভর্তি হন।

চাচাতো বোন বেগম ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে।


১৯৪০ সালে মুজিব নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

১৯৪২ এন্ট্রান্স (এখনকার এসএসসি) পাসের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ বছরই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরের বছর মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

১৯৪৬ সালে মুজিব ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন।

পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।

'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগের 'ষড়যন্ত্রের' প্রতিবাদে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট ডাকে। ধর্মঘট পালনকালে সহকর্মীদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন মুজিব। ছাত্র আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার।

ফরিদপুরে কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান মুজিব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাদের দাবি আদায়ে ধর্মঘট ঘোষণা করলে মুজিব সমর্থন জানান।

কর্মচারীদের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ২৯ মার্চ কর্তৃপক্ষ তাকে জরিমানা করে। এ নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহি�কৃত হন মুজিব। ১৯ এপ্রিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। কারাবন্দি মুজিব এর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জুলাই মাসে মুক্তি পেয়েই খাদ্য সঙ্কটের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে গ্রেপ্তার হন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভুখা মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ায় ১৪ অক্টোবর তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এবার প্রায় দু'বছর পাঁচ মাস জেলে আটক রাখা হয় মুজিবকে।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে বন্দি অবস্থায় ২১ ফেব্র"য়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসবে পালনের জন্য সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহবান জানান মুজিব।

এ দাবিতে ১৪ ফেব্র"য়ারি জেলখানায় অনশন শুরু করেন তিনি।

২১ ফেব্র"য়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাজের মিছিলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর শহীদ হন।

মুজিব জেলখানায় এর প্রতিবাদে টানা ১৭ দিন অনশন করেন।

১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টিই পায় যুক্তফ্রন্ট। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের আসনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করেন।

১৫ মে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বন মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। ৩০ মে মুজিব করাচি থেকে ঢাকায় ফেরেন এবং গ্রেপ্তার হন। ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি পান।

১৯৫৫ সালের ৫ জুন মুজিব গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৭ জুন পল্টন ময়দানের জনসভায় আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ২১ দফা ঘোষণা করে।

দলকে সব ধর্মের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দ প্রত্যাহার করা হয়। মুজিব আবার দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

সংগঠনকে সুসংগঠিত করতে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

পরের বছরের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১১ অক্টোবর মুজিবকে গ্রেপ্তার করে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে। প্রায় চৌদ্দ মাস পর মুক্তি দিয়ে আবার জেলগেটে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের এক সভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও মুজিব সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্র"য়ারি মুজিব ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি জোরালোভাবে তোলা হয়।

১ মার্চ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন।

১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন মুজিব।

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার তাকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ শুরু হয়।

১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদ আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও মামলায় আটকদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে যা। গণআন্দোলনে পরিণত হয়।

১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ, পুলিশ-ইপিআর এর গুলি আর বহু হতাহতের মধ্য দিয়ে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে আইয়ুব সরকার ১ ফেব্র"য়ারি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানায়।

২২ ফেব্র"য়ারি চাপের মুখে সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে মুজিবসহ আসামিদের মুক্তি দেয়।

২৩ ফেব্র"য়ারি রেসকোর্স ময়দানে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দেওয়া হয়। এ সময় তিনি ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানান।

২৬ ফেব্র"য়ারি বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, গণঅসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ মার্চ তিনি বৈঠক ত্যাগ করে ঢাকা চলে আসেন।

২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন।

১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন।

৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টির মধ্যে ৩০৫টি আসন পায় দলটি।

১৩ ফেব্র"য়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। কিন্তু
১ মার্চ তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আওয়ামী লীগ ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল ডাকে। হরতালের পরদিন বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।

৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু অনিবার্য হয়ে ওঠা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়ে ঘোষণা দেন� "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টোর আলোচনা হয়।

২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। বলা হয়ে থাকে এ সময় পাকিস্তানী বাহিনী আসলে দমন অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতেই নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

বঙ্গবন্ধু ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি বার্তা পাঠাতে সক্ষম হন। এতে তিনি বলেন, "সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। ." তিনি সবাইকে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করার আহ্বান জানান।

২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।

এরপর ২৭ মার্চ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান ঘোষণাপত্রটি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার পাঠ করেন।

২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেন এবং তাকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।

১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ হয়।

নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশকে সহায়তাকারী ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশী মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নতি স্বীকার করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়।

বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছলে তাকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭৩ এ নতুন সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩টি। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়।

যুুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতিসহ নানা ধরণের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।

১৯৭৫ সালের ৬ জুন বঙ্গবন্ধু এক বিতর্কিত উদ্যোগে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাকে এটি করতে হচ্ছে এবং এটি দেশের জন্য ভালো হবে।