বয়সজনিত কারণে চোখের ছানি হয়ে থাকে। ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাটারেক্ট। আমাদের দেশেও এ রোগটি রয়েছে। অসাবধানতা, দরিদ্রতা, অবহেলার কারণে এর চিকিৎসা হয় না। কিন্তু এর রয়েছে উন্নত চিকিৎসা। অত্যন্ত কম খরচে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। ক্যাটারেক্ট বা ছানি রোগ বিষয়ে আমরা শরণাপন্ন হই অধ্যাপক এএসএম কামালউদ্দিনের। তিনি এ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। অধ্যাপক কামালউদ্দিন ঢাকার ইসলামিয়া চু হাসপাতালের অধ্যাপক ও পরিচালক। এ বিষয়ে তার পারঙ্গমতা সর্বজনবিদিত। সারা দেশে তার প্রচুর সুখ্যাতি। তার কাছেই শুনুন ছানি রোগ ও এর চিকিৎসা বিষয়ে।
সাাৎকার নিয়েছেন স্বকৃত নোমান
সাপ্তাহিক : চোখের ছানি কী?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : প্রকৃতপে আমাদের চোখ আর ক্যামেরার ম্যাকানিজম প্রায় এক। বাইরের কোনো ছবি ক্যামেরার লেন্সে একটি ছায়া তৈরি করে যে ছায়া প্রিন্ট হয়ে আসলে আমরা ছবিটা দেখতে পাই। ক্যামেরার মধ্যে একটি বা একাধিক লেন্স দিয়ে এই ছায়াটা তৈরি করা হয়। ঠিক তেমনই মানুষের চোখেও একটি লেন্স থাকে। এই লেন্সের মাধ্যমে বাইরের ছবি চোখের রেটিনার ওপরে পড়ে। রেটিনার ওপরে পড়লে রেটিনা থেকে এটি মস্তিষ্কে চলে যায় আমাদের নার্ভস সিস্টেমের মাধ্যমে। ফলে আমরা দেখতে পাই। যে লেন্সের মাধ্যমে বাইরের যে কোনো জিনিসের ছবি আমাদের রেটিনার ওপরে পড়ে সে লেন্স যে কোনো লেন্সের মতোই স্বচ্ছ, যার কারণে আমরা ছবি দেখতে পাই। কিন্তু যেহেতু এই লেন্সটি সাধারণ কাচের লেন্স নয় এবং এটি বায়োলজিক্যাল অথবা মানুষের শরীরের কোষ থেকে তৈরি। তাই বয়সের কারণে অথবা আঘাত বা অন্য কোনো কারণে এই লেন্সটি স্বচ্ছ নাও থাকতে পারে। যদি ঘোলা হয়ে যায় তখন বাইরের ছবি থেকে যে আলো আসবে তা রেটিনার ওপর পড়বে না। এই ঘোলা হয়ে যাওয়াকেই বলা হয় চোখের ছানি।
সাপ্তাহিক : ছানি কেন হয়?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : প্রকৃতপে লেন্স তৈরি হয় আমাদের শরীরের কোষ দিয়ে। শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন বিভিন্ন কারণে তিগ্রস্ত হতে পারে, আঘাতের কারণে বা বয়সের কারণে পরিবর্তিত হতে পারে, ঠিক তেমনই লেন্সটা যেহেতু শরীরেরই একটা অংশÑ লেন্সেরও এই পরিবর্তন হতে পারে। কোনো কারণে যদি লেন্সের পরিবর্তন হয় তখন লেন্স ঘোলা হয়ে যেতে পারে। শরীরের যে কোনো জিনিসকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ রাখা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। আমাদের শরীরে আমাদের চোখের লেন্সকে জেনেটিক সিস্টেম এমনভাবে তৈরি করেছে যেন এটি সারাজীবন স্বচ্ছ থাকে। কোনো কারণে এই স্বচ্ছতার সিস্টেমের মধ্যে সামান্যতম সমস্যা দেখা দিলেই এই লেন্সটা ঘোলা হয়ে যেতে পারে।
সাপ্তাহিক : ছানি শুধু কী বয়স্ক ব্যক্তিদেরই হয়?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : চোখের ছানি শুধু বয়স্ক ব্যক্তিদেরই হয় না, তবে বয়স্ক ব্যক্তিদের বেশি হয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সমস্ত অঙ্গই অকার্যকর, দুর্বল হতে থাকে। একই প্রক্রিয়ায় চোখের লেন্সও একসময় না একসময় ঘোলা হয়ে যাবে। আমাদের দেশে প্রাপ্ত ছানির ৮০ ভাগই বয়সের কারণে হয়ে থাকে।
সাপ্তাহিক : ছানির পরিণতি কী?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : ক্যাটারেক্টের পরিণতি অন্ধত্ব। লেন্সটা স্বচ্ছ থাকলে, বাইরের আলো চোখের মধ্যে পড়লে আমরা দেখতে পাই, কিন্তু যদি লেন্সটা ঘোলা হয়ে যায় তাহলে বাইরের আলো চোখের রেটিনাতে পড়বে না। ফলে রোগী দেখবে না। প্রথমেই যদি সামান্য ঘোলা হয় তাহলে সামান্য কম দেখবে। আস্তে আস্তে যত বেশি লেন্স ঘোলা হতে থাকবে রোগী তত কম দেখবে। একপর্যায়ে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
সাপ্তাহিক : চোখের ছানি অপারেশনের আগে অনেক সময় ডাক্তার রোগীকে কিছুদিন অপো করতে বলেনÑ এর কারণ কী?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : না, ছানি অপারেশনের আগে সামান্যতম দেরি করার দরকার নেই। প্রকৃতপক্ষে আগেকার দিনে যখন উন্নত প্রযুক্তি ছিল না, মাইক্রোস্কোপ বা ফ্যাকোসার্জারির প্রযুক্তি ছিল না, তখন আমরা খালি চোখে ছানি অপারেশন করতাম। যেহেতু লেন্স অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং অত্যন্ত কোমল গঠনের তাই তখন ছানি অপারেশনের সময় লেন্সটাকে সম্পূর্ণ বের করে নিয়ে আসা হতো। তারপর চশমা দিয়ে রোগীর পরবর্তী চিকিৎসা করা হতো। ছানি যখন পাকে মানে ছানিটি যখন শক্ত হয়ে সাদা যায়, তখন এর সংযোগগুলো হালকা হয়ে যায়। তখন এটাকে বের করে আনা সুবিধাজনক। এজন্য আমরা রোগীদের বলতাম, ‘আপনার ছানি এখনো পাকেনি, ছানি পাকুক, তারপরে অপারেশন করুন।’ কিন্তু এখন যত তাড়াতাড়ি ছানি অপারেশন করা যায়, ততই ভালো এবং সুবিধাজনক। কারণ বয়স বাড়লে নানা রোগ দেখা দেয়। সুতরাং আগে করে ফেলাটাই ভালো।
সাপ্তাহিক : স্বাস্থ্যগত কোনো কারণ কি চোখের ছানি অপারেশনের জন্য বাধা হতে পারে?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : স্বাস্থ্যগত কারণ ছানির কারণও হতে পারে, আবার ছানি অপারেশনের বাধাও হতে পারে। যেমন ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত রোগ, জন্মগত ভাইরাস, ইনফেকশনÑ এগুলোর জন্য ছানি হতে পারে। ছানি অপারেশনের পূর্বে আমরা রোগীর স্বাস্থ্যের কতগুলো পরীা করে নিই, যাতে ছানি অপারেশনে কোনো সমস্যা না হয়।
সাপ্তাহিক : ছানি অপারেশন কী কোনো বড় অপারেশন?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : খুব বড় ধরনের অপারেশন নয়। তবে অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির অপারেশন এটি। সাধারণত কোনো অপারেশনের সঙ্গে ছানি অপারেশনের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলোÑ অন্য অপারেশনে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েই অপারেশন করি; যাতে কোনো ইনফেকশন না হয়। তারপরও যদি কোনো সমস্যা বা ইনফেকশন হয় সেই সমস্যাটাকে আস্তে আস্তে মেকাপ করা যায়। ছানি ছোট্ট একটা অপারেশন। এই অপারেশনে যদি কোনো ইনফেকশন হয় রোগীর দৃষ্টি সারাজীবনের জন্য নষ্টও হয়ে যেতে পারে। এজন্য ছানি অপারেশন যেখানে করা হয় সেখানে অন্য অপারেশন করা হয় না।
সাপ্তাহিক : অপারেশনের কতদিন পর রোগী বাড়ি যেতে পারে?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : এক ঘণ্টা পরেই যেতে পারে।
সাপ্তাহিক : অপারেশনের পর রোগীর দৃষ্টিশক্তির উন্নতি কতটুকু হয়? সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কেমন সময় লাগে?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : রোগীর যদি অন্য কোনো রোগ না থাকে তবে এক শ ভাগ উন্নতি হবে। সুস্থ হতে আমরা সাধারণত ২৪ ঘণ্টা ব্যান্ডেজ রাখতে বলি, তারপর বলি কালো চশমা পরতে। দু-একদিন সাবধান থাকতে হবে, সাতদিন পর পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়।
সাপ্তাহিক : অপারেশন পরবর্তী রোগীর যতœ সম্পর্কে বলুন?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : এখনকার উন্নত চিকিৎসায় বিশেষ কোনো যতœ নিতে হয় না। তবুও জোরে চিৎকার করা, দৌড়ানো, মাথা ঝাঁকানোÑ ইত্যাদি কাজ না করলেই ভালো। ৭-১৫ দিন পানি না লাগাতে বলি আমরা।
সাপ্তাহিক : অপারেশন পরবর্তী জটিলতা কী কী হতে পারে?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : কোনো জটিলতা হবে না। তবে অপারেশনের সময় ডাক্তারের অসতর্কতায় কোনো সমস্যা হলে কিছু কিছু রোগ দেখা দিতে পারে। এগুলোর চিকিৎসাও আছে।
সাপ্তাহিক : অপারেশনে কেমন খরচ হয়?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : একসঙ্গে অনেক রোগী অপারেশন করলে খরচ কমে আসে, মাত্র দুই-তিন হাজার টাকায় সম্ভব। কিন্তু অল্প রোগীর েেত্র খরচ তো বেশি পড়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এ অপারেশনের জন্য একটা মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। একটি দিয়ে তো অনেক রোগীর চিকিৎসা করা যায়। তা ছাড়া খরচ কম-বেশি সেটা লেন্সের ওপরও নির্ভর করে।
সাপ্তাহিক : বাংলাদেশে চোখের ছানি অপারেশনের বর্তমান প্রোপট/অবস্থা সম্পর্কে বলুন?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : চোখের ছানি অতীতের মতো বর্তমানেও আমাদের দেশে একটা সমস্যা। তবে আগের চেয়ে এখন এ সমস্যা অনেক কমে এসেছে। বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে। ২০০৩-এর এক বেসরকারি হিসাব মতে, আমাদের দেশে ৫ লাখ ৫০ হাজার ছানি রোগী রয়েছে। তার মধ্যে ২০০৩-এ অপারেশন হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার; যা মোট আক্রান্তের মাত্র ৫ ভাগের ১ ভাগ। প্রতি বছর নতুন নতুন রোগী যোগ হচ্ছে। সেই হিসাবে সামগ্রিকভাবে এগুলোর চিকিৎসা করাতে গেলে প্রতি বছর আড়াই থেকে তিন লাখ অপারেশন করতে হবে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে এ নিয়ে। এর চিকিৎসা এখন অনেক সহজ এবং স্বল্প খরচে করা যাচ্ছে। ছানি সাধারণত বয়স্ক রোগীদের বেশি হয়। অসচেতনতার কারণেই অনেকাংশে এর চিকিৎসা হচ্ছে না। বেশিরভাগ েেত্র দরিদ্রতার কারণে রোগীরা এর চিকিৎসা নেয় না। তা ছাড়া আমাদের চিকিৎসক, জনবল এবং যন্ত্রপাতিরও সংকট আছে। তাই এসব েেত্র আমাদের আরও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
সাপ্তাহিক : উন্নত বিশ্বে বর্তমানে চোখের ছানি অপারেশনের কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়? বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা কতটুকু?
অধ্যাপক কামালউদ্দিন : উন্নত বিশ্বে যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয় বাংলাদেশেও এখন তাই হচ্ছে। যান্ত্রিকভাবে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও সেসব দেশে যে রেজাল্ট, আমাদের দেশেও একই রেজাল্ট।
ছবি : রাশেদুজ্জামান
অধ্যাপক এ.এস.এম কামালউদ্দিন
চেম্বার : ৩০ গ্রিন সুপার মার্কেট (দ্বিতীয় তলা)
গ্রিন রোড, ফার্মগেট, ঢাকা
রোগী দেখার সময় : বিকেল ৫টা থেকে ৮টা
শুক্রবার ও শনিবার ছাড়া)
ফোন : ৮১২২৪৭০